ফ্ল্যাশলাইটের তীক্ষ্ণ আলোয় জলদানবটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিতে থাকে বৃদ্ধ লোকটি।
লালচে উজ্জ্বল তামার একটা প্রলেপ শরীরের পিঠ বেয়ে বেয়ে নিচে নামার সময় ঝাপসা হতে হতে পেটের কাছে এসে সাদা রঙে মিলিয়ে গেছে সে জলরং।
৩৮ ইঞ্চি লম্বা। একটু আগে মেপে দেখেছিল লোকটি।
মুখ থেকে এখনো হুক খুলে ফেলা হয়নি। মাছটার ঠোঁটের কোণে এখনো গেঁথে আছে। কিছুক্ষণ পরপর মাছটি বিশাল হা করে ছুটিয়ে নিতে চাইছে সেই বড়শির বাঁধন। আর সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে আসছে মুখভর্তি ওপর আর নিচের চোয়ালে সাজানো সারি সারি ছোট ছোট দাঁত। কেমন যেন অতি দানবীয় একটা ভয়ের দৃশ্যের মতো সামনে বসে থাকা শিকারটিকে মুখে পুড়ে নিয়ে অসংখ্য দাঁত দিয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছে এক নিমেষে।
হাতে প্লাইয়ার্স নিয়ে এগিয়ে যায় লোকটি। হুকের গোড়ায় প্লায়ার্স লাগিয়ে আলতো পেছনে ঠেলা দিতেই খুলে আসে হুক। এখন মাছটাকে ছেড়ে দেওয়ার পালা।
বড়শিতে গেঁথে টেনে আনার সময় তেমন একটা বেগ পেতে হয়
না। রডের ঝাঁকুনিতে বড় বড় সব মাছ উঠিয়ে আনা যায়। কিন্তু ছেড়ে দেওয়া অন্য রকম কসরত।
মাছ লাফাতে থাকে অনবরত। পিছল অথচ অসম্ভব ভারী এই প্রাণীটিকে আর কোনো রকম আঘাত না দিয়ে পাথুরে খাড়াই বেয়ে পানির সমতলে গিয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিতে হয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে এসে মিলিয়ে যেতে থাকে ভোরের দোরগোড়ায় চলে আসা উত্তরীয় কোনো এল বাতাসে।
চাঁদ অনেক আগেই হেলে গিয়েছে পশ্চিম কোণে। ডুবি ডুবি করার দোহাই দিয়ে ভেসে ভেসে জলকেলি করে নিচ্ছে আসন্ন প্রভাত রজনীর প্রথম জোয়ারের জলে।
মাথার ওপরে আকাশটাকে দেখে নেয় বৃদ্ধ লোকটি একবার। জলচর আকাশের বাতায়নে ছাড়া ছাড়া মেঘ বুনোনির মাঝেমধ্যে ইতিউতি উঁকি দিচ্ছে কিছু সাহসী তারা। সকালের প্রথম আলোয় ঝলসে মিলিয়ে যাওয়ার কথা জেনেও এতটুকু ভয় নেই তাদের মনে।
উঠে পড়ে লোকটি। অনেকখানি হাঁটতে হবে যে।
মূল স্থলের সঙ্গে ডৌফিন দ্বীপটি বিশাল এক সেতুর সুতোয় গেঁথে আছে। ব্রিজটি লম্বায় যতখানি, উচ্চতায় তার দ্বিগুণ। বিশাল বিশাল মালবাহী জাহাজের আনাগোনা এর নিচ দিয়ে। তাই হয়তো ইঞ্জিনিয়াররা ভেবেচিন্তে এই বিশাল উঁচু ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছে। তাতে বৃদ্ধ লোকটির কোনো সমস্যা ছিল না, যদি তাঁর বাহনের অবস্থা ভালো হতো।
তাঁর বাহন বলতে শেভরলের ১৯৫৭ সালের একটা ঝরঝরে হাড় জিরজিরে রোঁয়া ওঠা মরচে পড়া স্টেশন ওয়াগন। এই বাহন দিয়ে হয়তো সমতলে এখনো চলেফিরে বেড়ানো যায়। কিন্তু ডৌফিনের এই উঁচু ব্রিজ, নাহ্ সে অসম্ভব! ঢাল বেয়ে উঠতেই পারবে না, পেছনে গড়িয়ে পড়ে যাবে।
কিন্তু লোকটির মাছ ধরার জায়গায় আসা চাই-ই চাই। এইটা তাঁর অনেক প্রিয় একটা জায়গা।
মবিল বে–তে চন্দ্রাস্তছবি: লেখক
দুর্গম আর দুঃসাধ্য বলেই হয়তো মানুষ খুব একটা আসে না। জনমানবহীন এই পাথুরে জেটিতে সম্পূর্ণ নিজের একটা সংসার পেতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কাটিয়ে দেয় বুড়ো লোকটি। ভালো লাগে তাঁর। এই জন্যই প্রত্যেকবার ব্রিজের অন্য পাশে স্টেশন ওয়গনটি রাস্তার পাশে ফেলে রেখে সেই পর্বতসমান ব্রিজ ডিঙিয়ে চলে আসে অপর পাশে, মাছ ধরতে।
এলো পাথরের বুনো জঙ্গল বোঝাই সেই বাঁধ ডিঙিয়ে মেইন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। প্রায় মাইল খানিকের মতন চড়াই-উতরাই। তেমন একটা সমস্যা হবে না তাঁর। দেখতে দেখতেই সময় কেটে যাবে। আজ মনে অনেক আনন্দ। অনেক দিনের অপেক্ষা আজ তাঁর শেষ হয়েছে। মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটে ওঠে তাঁর ভাবতে ভাবতেই।
এগিয়ে যেতে যেতে আস্তে আস্তে খুলে নিতে থাকে গায়ে জড়ানো অতিরিক্ত কাপড়ের পরত। বাঁধের ওপরে হালকা বাতাসের টান আছে। লবণগোলা বাতাসে মশা কিংবা মাছি তেমন একটা বিরক্ত করে না।
অন্ধকার জনশূন্য রাস্তায় হুটহাট ছুটে আসে একটি-দুটি গাড়ি। গাড়ির হেডলাইটে ক্ষণিকের জন্য উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যায় দুস্তর অনন্ত এই চরাচর।